গোল টেবিল বৈঠক

গোল টেবিল বৈঠক (রম্যরচনা)
সত্যজিৎ বিশ্বাস
গোল টেবিল বৈঠকের শুরুতেই গোলযোগ শুরু হওয়ায় চোখ দুটো গোল্লা পাকিয়ে মা দুর্গা সবার দিকে তাকালেন। কীসের কী? কেউ ফিরে তাকালে তো? দেখেও না দেখার ভান করে উপস্থিত সভ্যরা গোলমাল চালিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ কী একটা মনে হতেই কেশে উঠলেন দশভূজা। এবার যেন ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। কাশির শব্দ শুনে নিমিষেই সব কোলাহল থেমে গেল। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, অসুর সবাই চমকে তাকাল দেবীর দিকে।

লক্ষ্মী: মা, তোমার কি হয়েছে? কাশি দিলে যে?
দেবী দুর্গা: বিচলিত হয়ো না মা। আমার কিছু হয়নি। তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যেই এ কাশির উৎপত্তি।
গণেশ: সত্যি বলছ তো জননী? এ সময়ে কাশি তো ভাল কথা না।
দেবী দুর্গা: কী যে বলিস না, কাশির কি আর সময়-অসময় আছে? সে তো যে কোন সময়ই আসতে পারে।
কার্তিক: আগে ছিল না, মা। এখন আছে। এখন কাশি দিলে মেরু প্রান্ত থেকে শুরু করে কাশিবাসীদের অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। চারপাশের মানুষ দৌড়ে পালায়।
দেবী দুর্গা: তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। সেই জন্যই তো মিটিং এ বসলাম। অথচ তোরা নিজেদের মধ্যে হাউকাউ করেই যাচ্ছিস। কাজের কথা কিছুই বলছিস না। পুজো তো এসে গেল। এদিকে করোনায় মর্ত্যের যে সবাই মরতে বসেছে। কী করা যায় বল তো?
অসুর: হে মা জগদ্ধাত্রী, আপনি অভয় দিলে আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি।
কার্তিক: আচ্ছা অসুর, তার আগে একটা কথা বলো তো, এত তেল দিয়ে কথা বলা কার কাছ থেকে রপ্ত করেছ?
দেবী দুর্গা: ছিঃ কার্তিক, এটা কেমন ধরনের কথা হলো? অসুর বাছা আমার, তুই নিঃসঙ্কোচে বলে ফেল।
অসুর: অনেক ভেবে দেখলাম মা। করোনার কারণে মর্ত্যের অবস্থা তো ভয়াবহ।
দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কাউকেই তো করোনা করুণা করছে না। আমি বলি কি, এবার পিত্রালয়ে না গেলেই কি নয়?
লক্ষ্মী: কি বললে এটা? তোমার ব্যাপারটা কি বলো তো অসুর? মা বছরে একবার আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসে। পুরো বছর জুড়ে এটা আমাদের সেরা আনন্দ। সেটা কি তুমি চাও না?
সরস্বতী: শুধু কি তাই? মর্ত্যবাসীরাও কত না আগ্রহে সারা বছর ধরে দিন গুনে অপেক্ষা করে আমাদের জন্য। তাদের সবার আগ্রহে জল ঢালার এমন প্রস্তাব তুমি করতে পারলে? অবশ্য পারবে নাই বা কেন? সারা মর্ত্য তো এখন অসুরেরই জয় জয়কার। আমরা না গেলে মর্ত্যবাসীরা আমাদের ভুলতে বসবে আর তুমি এ সুযোগে তোমার রাজত্ব গেড়ে বসবে মহানন্দে।
অসুর: দিদিরা, দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি যদি ভুল বলে থাকি করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, মর্ত্যে গিয়ে কেউ একজন করোনা বাঁধিয়ে ফেললে কী অবস্থা হবে আমাদের গোটা টিমের? করোনা তো ধনী, গরিব, সাদা, কালো, ভিআইপি, সিআইপি কাউকেই মানছে না। একটা এক্সিডেন্ট হলে কি অবস্থা হবে তখন? শুধু কি তাই? বিসর্জন শেষে ফিরে আসার সময় স্বর্গদ্বারের চেকিং এ যদি আটকে দেয়? যদি আমাদের আর ঢুকতে না দেয়, তখন কই যাবো?
দেবী দুর্গা: হুম, তোর কথায় যুক্তি আছে বাছা। বড়ই চিন্তায় ফেললি তো।
লক্ষ্মী: মা তুমিও না? আমি লক্ষ্মী থাকতে কী সব অলক্ষ্মী চিন্তা শুরু করলে? এসব কিচ্ছু হবে না। অসুর: লক্ষ্মী দিদি, মার্জনা করবেন। এসব কিচ্ছু যদি নাও হয়, তবুও সমস্যা আছে। চেকিং ছাড়াই কোনভাবে স্বর্গদ্বারের রক্ষীর হাতে কিছু গুঁজে দিয়ে স্বর্গে ঢোকার ইমিগ্রেশন পেয়ে গেলেও কি শেষ রক্ষা হবে? আমাদের কাছ থেকে স্বর্গের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে পিঠের ছাল চামড়া কি থাকবে আমাদের? অভিশাপেই তো ভস্ম হয়ে যাবো সবাই।
কার্তিক: আচ্ছা অসুর, আমরা আক্রান্ত হবোই, এমনটা ভাবছ কেন বলো তো? মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, এয়ার প্রটেক্টর সানগ্লাস, মুনগ্লাস, পিপিই এসব পরে গেলেই তো আর কোন ভয় থাকবে না।
অসুর: দাদা, ভয় তো আর আমার না বরং তোমাদেরই। মর্ত্যে গিয়ে আমি থাকি মায়ের পায়ের নীচে পড়ে। আমাকে তো আর কেউ প্রণাম করতে আসবে না। আসবে তোমাদের প্রণাম করতে। লক্ষ লক্ষ ভক্ত যখন হাত দিয়ে, কপাল দিয়ে তোমাদের পা ঘষাঘষি করবে, তখন কিভাবে নিজেদের রক্ষা করবে শুনি?
কার্তিক: তাই তো! তাহলে? ইয়ে মানে, একটু পর পর স্যানিটাইজার স্প্রে করলেও কি শেষরক্ষা মানে আত্মরক্ষা করা যাবে না?
অসুর: এমন সুহৃদ কে আছে? কে একটু পরপর স্যানিটাইজার স্প্রে করার দায়িত্ব নেবে দাদা?
কার্তিক: ইয়ে গণেশ, ভাই আমার, তুমি কি এবার একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে পারবে না?
গণেশ: দাদা, তোমার কথা শুনে মেজাজ এমনিই টং হয়ে আছে। আর মেজাজ খারাপ করে দিও না বললাম।
কার্তিক: ওমা, আমি আবার কি বললাম? গনেশ: নিজের চিন্তা ছাড়া একবারও ছোট ভাইটার কথা ভেবে দেখেছ? মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, এয়ার প্রটেক্টর সানগ্লাস, মুনগ্লাস, পিপিই পরে বাবু সেজে মর্ত্যে যাবার আনন্দে বিভোর হয়ে আছো। আমি কি করে মাস্ক পরে যাবো, সে কথা একটি বারের জন্যও ভেবেছ? এখন যেই না অনবরত স্প্রে করার কথা এলো, ওমনি মনে পড়লো আমার কথা!
কার্তিক: ছিঃ ছোট, এভাবে বলতে পারলে? আমি বুঝি তোমাকে আগলে রাখি না? গণেশ: ‘আগলা’ রাখ নাকি ‘আলগা’ রাখ, সে কথা জাতি জানে। মন্ডপে গিয়ে একটা সাইড বেছে নিয়ে সবার আগে দাঁড়িয়ে পড়ো। আর আমাকে পাঠাও একেবারে অন্য সাইডে – এই হলো তোমার আগলে রাখার ধরণ।
অসুর: দাদারা, এখন ব্যক্তিগত রোষ ঝাড়ার সময় নয়। আসো, করোনা ঝড়টা আগে সামলাই, তারপর ওসব নিয়ে একদিন বসা যাবে। তো যা বলছিলাম, ধরে নিলাম করোনা ছাড়াই আমরা স্বর্গে ল্যান্ড করলাম। তাতেও কি লকডাউন এড়াতে পারব? চৌদ্দদিন আমাদের সবগুলো বাহন মানে সিংহ, ময়ূর, ইঁদুর, প্যাঁচা, হাঁস, সাপ সব্বাইকে নিয়ে একসাথে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে না? তার সাথে থাকবে মন্ডপে মন্ডপে কালেকশন করা শাড়ি, কাপড়, শাঁখা, সিঁদুরের লটবহর। এর মধ্যে কীসের সাথে করে করোনা চলে আসবে, চেক করা সম্ভব?
লক্ষ্মী: কিন্তু তাই বলে, বছরের সবচেয়ে জমজমাট আয়োজন এবার ভেস্তে যাবে? সবাইকে নিয়ে একবার যাই মামা বাড়ি, তাও বাতিল হবে? এটা কোন কথা হলো?
সরস্বতী: ঠিকই বলেছ দিদি, এটা কোন কথা হলো? তাছাড়া ভক্তদের কথা কি ভেবে দেখেছ? ওরা কত কষ্ট পাবে সেটা ভাবলে না?
গণেশ: আমাদের সবারই যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এতে তো কারও দ্বিমত নেই। কিন্তু অসুরের কথাগুলো তো ফেলে দেবার মতো নয়। ওর প্রতিটা কথায় যুক্তি আছে। আগে তো নিরাপত্তা, তাই না?
লক্ষ্মী: ছিঃ গণেশ, তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। আমাদের ভাই হয়ে কিনা তুমি অসুরের পক্ষ নিচ্ছো?
গণেশ: কারো পক্ষ নিয়ে কথা বলতে যাবো কেন? আর যদি বলেও থাকি, সেটা যুক্তির পক্ষে। অসুর তো অযৌক্তিক কিছু বলেনি। তাছাড়া আমার তো মনে হয় না, তোমরা দু’বোন ভক্তদের কথা ভেবে যাওয়ার জন্য এত কাতর হচ্ছো? যাবে তো শপিং করতে। সাথে মন্ডপে মন্ডপে শাড়ি কালেকশন তো আছেই।
সরস্বতী: কী, এত বড় কথা? মা, তুমি কি কিছু বলবে গনশাকে?
দেবী দুর্গা: উফ, তোমরা থামবে? আমি তো ভেবেই কোন কূল পাচ্ছি না। আজকের মতো বৈঠক এখানেই মুলতুবি ঘোষণা করলাম। আজ সারাদিন বসে ভাবব, কী করা যায়। কার্তিক, তুমি গণেশকে নিয়ে আজকের বাজারটা করে নিয়ে আসো। অসুর, ঘর ঝাড়ু দিয়ে ভাল করে মুছে ফেল ফ্লোর। টাইলসে একটুও ময়লা যেন না থাকে। লক্ষ্মী, এক চুলায় ভাত বসাও। আর সরস্বতী, কড়া করে এক কাপ কফি নিয়ে আসো আমার জন্য। তোমরা সবাই এখন যাও, আমাকে ডিস্টার্ব করবে না কেউ।

সরস্বতী বিশ মিনিট পর কফি নিয়ে এসে দেখে, মা চেয়ারে বসেই ঢুলছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *